Wednesday, August 14, 2013

সাংবাদিকতার নীতিমালা এবং নিউইয়র্কের সংবাদপত্র



সাংবাদিকতার নীতিমালা এবং নিউইয়র্কের সংবাদপত্র

-মোহাম্মদ বেলাল হোসেন

খন সময় আমেরিকায় যারা সাংবাদিকতা করেন বা করবেন, অন্যান্য পেশার মতো তাদেরও লাইসেন্স নেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যারা সাংবাদিকতা করছেন, তাদের অধিকাংশই সে ধরনের সরকারি অনুজ্ঞাপত্র বা পারমিট নিতে নানা কারণে উৎসাহী নন। তথাপি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যারা পাঠকের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্বটি পালন করছেন, তারা সাংবাদিকতার নীতিমালা বা কোড অব এথিকস মেনেই তা করছেন বলে মনে করি। 

প্রতিটি পত্রিকার নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার একটা ভিত রয়েছে; যার ওপর ভিত্তি করে পাঠক নির্ধারণ করেন পত্রিকাটি কতটা নির্ভরযোগ্য। সে কারণেই পাঠক নির্দিষ্ট কোনো পত্রিকা কেনেন বা পড়েন। সর্বোপরি, সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পূর্ণরূপে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার ওপর নির্ভর করে। পাঠক যখন বস্তুনিষ্ঠতার বিচার করবেন, তখন পাঠককে সুনির্দিষ্ট কতগুলো মাপকাঠির ভিত্তিতেই তা করতে হবে। কীভাবে সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো তুলে আনেন এবং পরিবেশন করেন,এখানে তার কিঞ্চিৎ আভাস দেয়ার চেষ্টা করছি।

সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে সংবাদের পাঠযোগ্যতার ওপরও নির্ভর করে। কোন লেখার পাঠযোগ্যতা কতটা পরিশীলিত, তা নির্ভর করে লেখার উপস্থাপন পদ্ধতি ও লিখনশৈলীর গুণগত মানের ওপর। সাংবাদিক কোনো গল্পকার নন। তাই, তিনি কোনো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে কিছু লিখনীকাঠামো অনুসরণ করেন। 

এক্ষেত্রে সাংবাদিক কোনো ধরনের ভূমিকা বা ভণিতা না করে সংবাদের শুরুতে কোনো ঘটনার মূল বিষয়বস্তুটি সংক্ষেপে উপস্থাপন করেন। তারপর বিস্তারিত ঘটনা গুরুত্বের পারম্পর্য অনুসারে বর্ণনা করেন। মূল বিষয়বস্তুটি সাধারণত কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে নিহিত থাকে। পরবর্তীকালে সম্পাদকরা এই মূল বিষয়বস্তুটিকে আরো সংক্ষিপ্তাকারে হেডলাইনে ব্যবহার করেন, যা কিনা সংবাদের গুরুত্ব নির্দেশ করে এবং পাঠককে পুরো সংবাদটি পড়তে অনুপ্রাণিত করে।

সাংবাদিকতার দুনিয়ায় বিভিন্ন মিডিয়ার নিজস্ব কোড অব এথিকস-এর পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে কিছু সর্বজনবিদিত নীতিমালা রয়েছে,তা হলো- সত্যবাদিতা, নির্ভুলতা, নিরপেক্ষতা বা বস্তুনিষ্ঠতা, গ্রহণযোগ্যতা ও সর্বোপরি জনগণের প্রতি জবাবদিহিতাদায়বদ্ধতা

সংবাদ লেখা বা কোনো ঘটনার রিপোর্ট তৈরি করা বিচারকের রায় লেখার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বিচারক তার রায় লেখার সময় যেমন মনে রাখেন, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন তার রায়ে সাজা না পায়; তেমনি সংবাদ লিখতে গিয়ে সাংবাদিককেও মনে রাখতে হয় -পাঠককে ঘটনা জানাতে গিয়ে যেন সংশ্লিষ্ট ঘটনার বাইরের কোনো ব্যক্তির সুনাম ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। 

তাই, তাকে ভাষার ব্যবহার, চিত্র সংযোজন, ব্যক্তির নামের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এজন্য শিশুদের নাম, কোনো ক্রাইম বা অপরাধের ভুক্তভোগীর নাম, ঠিকানা, সংবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তির নাম বা বক্তব্য যা ওই ব্যক্তির সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব।

বর্ণবাদী কোনো বক্তব্য বা কোনো ব্যক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে, এমন তথ্য বা জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গভেদ করতে পারে, এমন তথ্য উল্লেখ করা থেকেও সাংবাদিককে বিরত থাকতে হয়। কোনো ঘটনা যা আদালতে বিচারাধীন আছে, তা জানাতে গিয়ে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিরপরাধ ধরে নিয়ে বক্তব্য প্রদান করতে হয়। এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্তকে দোষী সম্বোধন করে সংবাদ লেখা সাংবাদিকতার নীতিমালা পরিপন্থি এবং এতে মানহানি বা আদালত অবমাননার মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হতে পারে।

সাংবাদিকতা একটি স্বাধীন পেশা বিধায় সাংবাদিক যে মিডিয়ায় কাজ করেন, সেখানকার ঘরোয়া নীতিমালার বাইরেও সাংবাদিককে ব্যক্তিগতভাবে তার নিজের সেন্সর বা সমালোচক হিসেবে কাজ করতে হয়। তাই, সাংবাদিকতায় নিজস্ব আবেগ, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা আর্থিক স্বার্থ চরিতার্থ করার কোনো বৈধতা নেই। তাই, সাংবাদিককে হতে হয়, তথ্যগত দিক দিয়ে পরিপূর্ণ, সৎ এবং পেশাদারিত্বের দিক দিয়ে নিবেদিতপ্রাণ। আংশিক সত্য প্রকাশ করলে সেখানে তথ্যগত ত্রুটির অবকাশ থাকে।

সাংবাদিকতা তথ্যভিত্তিক। এখানে কল্পনা, অনুমান বা রঙ চড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। যথাযথভাবে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি করতে হয়। তথ্য সংগ্রহ হতে পারে লিখিত আকারে, রেকর্ডারে, ভিডিও বা স্থির চিত্রের মাধ্যমে, টেলিফোনে বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে বা অন্য কোনো মিডিয়া থেকে। যেখান থেকেই তথ্য সংগৃহীত হোক না কেন, তথ্যের সত্যাসত্য এবং বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে নেয়ার দায়িত্ব সাংবাদিকেরই।

সাধারণত সাংবাদিকরা তাড়াহুড়ো করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন, পরবর্তীকালে যার সবটুকু সংবাদ বিবরণে নাও আসতে পারে। কিন্তু, তথ্য সংগ্রহের সময় একজন সাংবাদিক যত বেশি সবিস্তারে তথ্য ধারণ করবেন, ঘটনার সারবস্তু পাঠকের সামনে তুলে ধরা তার জন্য তত বেশি সহজ হবে। এতে তথ্যের বিকৃতি এড়ানো সম্ভব। সাংবাদিক তথ্যের জন্য অনেক সময় সোর্সের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু,কখনও কখনও সোর্স সাংবাদিককে ভুল তথ্য দিতে পারেন, বিভ্রান্ত করতে পারেন বা ভিন্নপথে পরিচালিত করতে পারেন। সেজন্য অবশ্যই সাংবাদিককে একাধিক গ্রহণযোগ্য মাধ্যমে বা সরেজমিন তদন্ত করে প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভুলতা যাচাই করে নিতে হবে।

সংবাদ লেখার সময় স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কারো দোষ আড়াল করা কিংবা নির্দোষকে দোষী সাব্যস্ত করা সাংবাদিকতার নীতিমালা বিরুদ্ধ এবং আইনের চোখে এক বড় অপরাধ। যদি কোনো সাংবাদিক এমন কোনো ঘটনা প্রকাশ করেন, যাতে কোনো নির্দোষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্মানহানি হতে পারে, তাহলে সে সাংবাদিক দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধী বিবেচিত হবেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমে অর্থাৎ ছাপা বা অন্য কোনো মাধ্যমে কারো মানহানি করাকে আইনের ভাষায় লাইবেল’ বলা হয়। বাংলাদেশ এবং আমেরিকা উভয় দেশেই সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানহানি করার বিরুদ্ধে কড়াকড়ি আইন বিদ্যমান। ‘লাইবেল’ বা মানহানির আইন অনুযায়ী অন্যের প্রকাশিত মানহানিকর বক্তব্য পুনর্বার কেউ প্রকাশ করলে সেও একইভাবে অপরাধী গণ্য হবেন।

বলা হয়ে থাকে, হাজার শব্দে যা বলা যায়, একটি ছবি তা প্রকাশ করতে পারে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবির ক্যাপশন থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো কুরুচিপূর্ণ, বীভৎস, অশ্লীল বা যৌন আবেদনময় ছবি সংবাদপত্রে ছাপানো অনৈতিক এবং আইন বিরুদ্ধ। যেহেতু, কোন বিশেষায়িত ম্যাগাজিন ছাড়া নিয়মিত সংবাদপত্র শিশু থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর পাঠক পড়েন, সেহেতু এতে ছবি ও ভাষার ব্যবহার হতে হবে শোভনীয়।

আগে সাংবাদিকতা পেশায় যারা আসতেন, তারা ছিলেন স্বশিক্ষিত অর্থাৎ জন্মগতভাবে সাংবাদিকতার গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তিরাই সাংবাদিকতা করতেন। এখন ডিগ্রি নিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন অনেক সাংবাদিক। এতে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি ও গুণগত মানের বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। যেহেতু, অন্যান্য চর্চিত ডিসিপ্লিনের মতো সাংবাদিকতার প্রয়োগ ও ব্যাপকতা সুবিস্তৃত, তাই স্বল্প পরিসরে এর নীতিমালা নিয়ে আলোচনা সম্পূর্ণ হবে না।

যত নীতিমালার কথাই বলা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত নীতি-নৈতিকতার চর্চা কে, কোথায়, কতটা করছেন, তা উদ্দিষ্ট মিডিয়া এবং সাংবাদিকের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত পাঠকরাই তা নির্ধারণ করতে পারেন।

নিউইয়র্কভিত্তিক বাংলা পত্রিকাগুলোর পাঠক বাঙালিরা। নতুন প্রজন্ম বাংলা না শেখার কারণে এবং ইংরেজি ভাষার প্রতি অনেকের বিশেষ দুর্বলতা থাকায় বাংলা পত্রিকাগুলোর পাঠক কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে। তথাপি সচেতন নাগরিকরা কোনো না কোনোভাবে পত্রিকা পাঠ করেন এবং এ সব পাঠক পত্রিকার গুণগত মান ও বস্তুনিষ্ঠতা ও দায়িত্বশীলতা বিচার করেই সে পত্রিকার তথ্যের ওপর আস্থা রাখেন।

লেখক: সাংবাদিক।

(লেখাটি প্রেসবার্তা থেকে সংগৃহীত)

No comments: