সাপতত্ত্ব চুলতত্ত্ব!
-আশিস বিশ্বাস
ঢাকা: কয়েক মাস আগে বিরক্তিকর একটা বিতর্ক চলেছিল। সেই বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলেছিল মিডিয়া। তবে সেই সঙ্গে মিডিয়া তাদের চরিত্রকে উলঙ্গ করে ছেড়েছিল। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল মিডিয়া। তারপরও তার সেই শিক্ষাটা নেয়নি তারা।
দিনকে দিনকে দেউলিয়াপনাত্ব প্রকাশ পাচ্ছে
প্রকটভাবে। বেশিদিন নয়, কয়েক মাস আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি
চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘সাপকে বিশ্বাস করা
যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না।’
এরপরেই শুরু হয়ে গেল কাদা ছোড়াছুড়ি। প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বললেন, ‘তিনি তো সাপের
ঝাঁপি নিয়ে চলেন, সাপের বিষেই ওঝার মৃত্যু হয়। তিনি সাপ বলতে জামায়াতে ইসলামীকে বুঝিয়ে
ছিলেন।
এরপরেই মিডিয়া হাউস গরম হয়ে গেল। কোথাও
কোনো দলের এমপি, মন্ত্রীকে হাতের কাছে পেলেই সাপের প্রসঙ্গ টেনে তোলেন সাংবাদিকেরা।
কথায় আছে না- একে তো নাচুনে বুড়ি, তারপর আবার ঢোলের বারি।’ রূপক অর্থে এই কথা বলার কারণ হলো, রাজনীতিবিদরা
অপেক্ষা করেন, কথন মিডিয়া তার সামনে আসবে কিংবা কোনো বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইবে।
টিভি ক্যামেরা, প্রিন্ট মিডিয়া, অনলাইন
মিডিয়ার সাংবাদিকরা এখন গিজগিজ করে। দেশে দ্রুত মিডিয়ার বিকাশ ঘটেই চলেছে, সে কারণে
সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়ছে। যাক, ফলস্বরূপ যা দাঁড়ালো, তা হলো মন্ত্রী বা এমপিকে কাছে
পেলেই সাংবাদিকরা জানতে চান, ওমুক নেতা ‘সাপ’ প্রসঙ্গ টেনেছেন, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য
কী। ব্যাস, অটোমেশিন শুরু হয়ে গেল। বক্তাকে যেন থামানোই যায়না। যিনি সাপ প্রসঙ্গ তুলেছেন,
তার ১৩ গোষ্ঠীকে আরো সাপ ধরিয়ে দিতে শুরু করেন তিনি। সেটা ক্ষমতাসীন দল কিংবা বিরোধী
দল যাই হোক না কেন! রেকর্ড একটাই। শুধু একবার অন করে দিতে পারলেই হয়, থামানো বড় কষ্ট!
ঠিক এমনি আরেকটি ঘটনা শুরু হয়েছে- ‘চুল’ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে
বলেছেন, আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে। এক চুলও নড়বো না। ব্যাস, আর
যায় কোথা! পরের দিন সোমবার বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ‘চুল’-এর জবাব ‘চুল’ দিয়েই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জনগণের আন্দোলনে
আওয়ামী লীগের ‘চুল’ও থাকবে না।
কী ভয়ঙ্কর কথা! তারমানে বিএনপি নির্বাচনে
জিতলে ২০০১ সালের মতোই নির্যাতন চালাবে? আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাটিতে পিষে ফেলা
হবে? জানি না, কথার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বললাম। কারণ, ২০০১ সালের ভয়াবহ নির্যাতনের
চাক্ষুষ একজন সাক্ষী আমি।
তাহলে ধরে নেবো, দুই নেতাই যদি অনড় থাকেন,
তাহলে সংঘাত অনিবার্য! আমাদের দেশটা কি তাহলে মিশরের মতো হবে?!
মাত্র এক সপ্তাহ আগে ঐশী তার বাবা-মায়ের
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কেউ কেউ এটা দুই প্রজন্মের
মূল্যবোধের দ্বন্দ্বকেও দায়ী করছেন। তারা বলছেন, আগের প্রজন্মের মূল্যবোধ (Values)
মানসিক চাহিদা, চাল-চলনের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মূল্যবোধের অনেক বড়
গ্যাপ (শূন্যতা) তৈরি হয়েছে; যার ফলে আগের প্রজন্মের মানুষেরা বর্তমান প্রজন্মের অনেক
কিছুকেই বলছেন, ‘উচ্ছন্নে গেছে’, ‘নষ্ট হয়ে গেছে’, ‘মা-বাবার কথা শোনে না’, ‘বাসার বাইরে যায়, ‘ফেরে দেরিতে’ ইত্যাদি।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, আগের প্রজন্মের
মানুষদের সঙ্গে এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মূল্যবোধ, রুচি মিলবে না। যেমন- আগের প্রজন্মের
ছেলে-মেয়ের একই কলেজে পড়লেও ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়ে কথা বলা ছিল নিষিদ্ধ। তারপর আগে মেয়েরা
ঘরের বাইরে গেলে কাউকে না পেলে ছোট ভাই কিংবা বোনকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যেতে হতো। আর
এখন রাত করে বাসায় ফিরলেও কৈফিয়ত দিতে হয় না। কারণ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদেরও ঘরের
বাইরে যেতে হয় বিভিন্ন কারণে। এটাকে আগের প্রজন্মের মা-বাবা ভালো চোখে দেখবেন না এটাই
স্বাভাবিক। কারণ, তাদের সময়ে এই সুযোগটা ছিল না।
আরো একটা ঘটনা বলি। যাদের বয়স ৪০ পেরিয়ে
গেছে, তাদের বেশির ভাগেরই ধারণা, একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে না। যদি
কথা বলে বা একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে, তবে তিনি ভাববেন, নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে।
অথচ দেখা গেল, তারা হয়ত দুজনই দুজনকে তুই-তোকারি
করছে। অত্যন্ত ভালো বন্ধুত্ব হতে পারে একটা ছেলে আরেকটা মেয়ের সঙ্গে। অথচ আগের প্রজন্মের
মানুষদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা, বন্ধুত্ব হয় একমাত্র ছেলেতে ছেলেতে কিংবা মেয়েতে মেয়েতে।
এটা একটা সমস্যা বটে। সমস্যাটা মূল্যবোধের,
রুচির। অভিভাবকদের এই প্রজন্মের মনস্তত্ত্বকে বিচার করতে হবে, এই প্রজন্মের চোখ দিয়ে,
এদের মন দিয়ে, এদের মূলবোধের সঙ্গে তাদের সময়কার মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে। মনে রাখতে
হবে, সংস্কৃতি কিন্তু বহমান নদীর স্রোতের মতোই, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না।
মূল্যবোধের বিবেচনায় সে কারণে ঐশীকে কেউ
দায়ী করছে না। তারা সবাই ধারণা করছেন, ঐশীর প্রজন্ম যে মূল্যবোধ অর্জন করেছে, স্বাধীনতা
অর্জন করেছে, তাতে হয়ত অভিভাবকরা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ফলে, শুরু হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক
দ্বন্দ্ব। এক সময় এই দ্বন্দ্বই চরম পর্যায়ে প্রকাশ পেতে পারে। যেমনটা ঘটেছে ঐশীর বেলায়।
নিজের ইচ্ছেগুলো অবদমন রাখতে রাখতে একসময় ঐশী নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনি।
শেষপর্যন্ত মা-বাবাকে হত্যার পথে এগিয়েছে,
নিজের বাধাকে অপসারণ করতে। কিন্তু তারপর কী করবে, সে ভাবনা ভাবার মতো বয়স তার হয়নি।
তার বয়স মাত্র ১৬। আরো ৩/৪ বছর পার হলে তার পরিপক্কতা বাড়তো। তখন যুক্তির কাছে তার
আবেগ মাথা নত করতো। কিন্তু তা আর হলো কই!
আইনের চোখে ঐশী হয়ত দায়ী। কিন্তু এর দায়
মূলত সমাজের। দায় তাদের, যারা সমাজের কর্ণধার তারা। তারা যে আচরণ করেন, তার প্রভাব
সমাজে পড়বেই। কিত্ত সাধারণ মানুষ সাধারণভাবে সেটা বুঝতে সক্ষম হলেও রাজনীতিবিদরা বুঝতে
চান না। তারা অনেক সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। কিন্তু তারা
যে জিনিসটা চেপে রাখেন তাহলো, ধর্মের ফলাফল পরলোকে, ইহলোকে নয়। তারা অন্যদের পরলোকের
লোভ দেখিয়ে নিজেরা ইহলোকের সম্পদ কুক্ষিগত করতে রাজনীতির মাঠে নামেন। ধর্ম ত্যাগ শেখায়,
রাজনীতি শেখায় লুণ্ঠণ।
এখন আমরা কী দেখতে পারছি, আমাদের রাজনীতিবিদরা
একমাত্র মলমূত্র ছাড়া আর কোনো কিছুই ত্যাগ করতে জানেন না। সমাজের জন্য কিছুই করেন না।
তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে কোত্থেকে?
দ্বন্দ্ব করে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করলে
সমাজের পরিবর্তন হয় না। বরং নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ঐশীদের মতো উত্তর প্রজন্মের
অধিকারকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছেন তারা।
এই প্রজন্ম সমৃদ্ধি চায়, চায় অর্থনৈতিকভাবে
স্বাবলম্বী হতে। চায় সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। কিন্তু, রাজনীতিবিদদের ‘সাপতত্ত্ব’, ‘চুলতত্ত্ব’ ‘তেঁতুলতত্ত্ব’ উত্তর প্রজন্মকে শুধু পেছনেই টেনে ধরছে।
সামনে আগাতে দিচ্ছে না। এর থেকে মুক্তি খুঁজতে উত্তর প্রজন্মকেই সমাজের, রাজনীতির হাল
ধরতে হবে। তা না হলে, এই সর্বনাশা তত্ত্ববাদীরা দেশকে পেছনে নিয়ে যাবে।
২০ আগস্ট, ২০১৩
No comments:
Post a Comment