Wednesday, August 14, 2013

ছাপা সংবাদপত্রের দিন শেষ?




ছাপা সংবাদপত্রের দিন শেষ?


ঢাকা: সংবাদপত্রের ভবিষ্যত নিয়ে জোরালো জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, ছাপা সংবাদপত্র উন্নতির শিখরে উঠে গেছে। এবার তার নামার পালা। জল্পনার শাখা-প্রশাখা ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগে না। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। অনেকে বলতে শুরু করেছেন, সংবাদপত্রের যুগ শেষ, সামনের দিনগুলোতে ছড়ি ঘোরাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মাইক্রোব্লগিং। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্টবিক্রি হয়ে যাওয়ার পর গত কয়েক সপ্তাহে এ আলোচনা আরো জমে উঠেছে।


পত্রিকার বিকিকিনি

সম্প্রতি দানবীয় ইন্টারনেট কোম্পানি আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও কোটিপতি জেফ বেজোস ২৫ কোটি মার্কিন ডলারে (প্রায় এক হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা) দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকিনে নিয়েছেন। এ ঘটনায় একটি বিষয় পরিস্কা, প্রযুক্তির সঙ্গে লড়তে গিয়ে ছাপা সংবাদপত্র হার মেনেছে এবং এ লড়াইয়ে প্রযুক্তি জিতেছে হেসেখেলে। এর আগে ২০১০ সালের আগস্টে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট কোম্পানি দ্য নিউজউইকবিক্রি করে দেয় হারমান ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে।

সে সময় দ্য নিউজউইক’-এর গ্রাহক সংখ্যা ক্রমে কমছিল। ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পত্রিকাটির রাজস্ব আয় ৩৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আরো ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পত্রিকাটি বিক্রি করে দেয় গ্রাহাম পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানিটি। এরপর ২০১০ সালের নভেম্বরে পত্রিকাটি ইন্টারনেট কোম্পানি আইএসির দ্য ডেইল বিস্ট’-এর সঙ্গে একীভূত হয়। দ্য নিউজউইক ডেইলি বিস্টনামে পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হলেও শেষরক্ষা হয়নি। এ বছরের ৩ আগস্ট ডিজিটাল সংবাদ কোম্পানি আইবিটি মিডিয়া আইএসির শেয়ার কিনে নেয় এবং দ্য নিউজউইকআবারও পৃথক পত্রিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন রেড সক্স নামে একটি ক্লাবের মালিক জন হেনরি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কোম্পানির কাছ থেকে বিখ্যাত দৈনিক দ্য বোস্টন গ্লোবকিনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জন হেনরি কেবল দ্য বোস্টন গ্লোবনয়, বরং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একগুচ্ছ সংবাদপত্রও কিনে নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম সফল বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেটের কোম্পানি বার্কশায়ার হ্যাথওয়ে গত দুই বছরে মোট ২৮টি সংবাদপত্র কিনেছে। এ নিয়ে বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের চেয়ারম্যান বাফেট ও ভাইস চেয়ারম্যান চার্লস টমাস মাঙ্গারকে কোম্পানির শেয়ারধারীদের কাছ থেকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে তাদের ব্যাখ্যা পত্রিকা কেনার বিষয়টিকে আরো জনপ্রিয় করেছে।

জানা গেছে, কট্টর দক্ষিণপন্থি কোটিপতি কোচ ব্রাদার্স ট্রিবিউন পত্রিকা নামে একগুচ্ছ পত্রিকার মালিকানা কিনে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। ট্রিবিউন গুচ্ছে আছে দ্য শিকাগো ট্রিবিউনলস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’-এর মতো নামকরা পত্রিকা।

ইতোমধ্যে, আরেকটি কথা বেশ ছড়িয়েছে। নিউইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ নাকি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকিনে নিতে শুলজবার্গ পরিবারকে এত বড় অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দিতে চলেছেন, যা শুলজবার্গ পরিবার ফিরিয়ে দিতে পারবে না। অবশ্য কোটিপতি ব্লুমবার্গ ইতোমধ্যে ব্লুমবার্গ নিউজ থেকেই বিরাট অঙ্কের মুনাফা অর্জন শুরু করেছেন।

ওয়েব ও প্রেসের লড়াই?

একসময়ের জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোর এভাবে বিক্রি হয়ে যাওয়া কি সংবাদপত্রশিল্প ও শ্রমিকদের জন্য আতঙ্কের ব্যাপার, নাকি নতুন সম্ভাবনার প্রসবযন্ত্রণা’? আসল ব্যাপারটি বুঝতে কয়েক দশক পেছনে ফিরে তাকানো প্রয়োজন। নব্বইয়ের দশকে যখন প্রযুক্তির আবির্ভাব হচ্ছে, তখন সংবাদপত্রশিল্প তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কবুল করেনি। বার্তাকক্ষে ইন্টারনেট ছিল অপাঙক্তেয়। একসময় ইন্টারনেট ব্রাউজারে পত্রিকা পড়া শুরু হয়।

কিন্তু তখন অনেকে এটির প্রতি নাক সিটকিয়েছেন। বলেছেন, এসব ছেলেপুলেদের খামখেয়ালি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবাদপত্রগুলো ইন্টারনেট ব্যবহার শুরুর অনেক দিন পরও ভাবতে পারেনি যে, ডিজিটাল জগ প্রেসের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এরও একটি ওয়েব ঠিকানা ছিল। এর একটি অনলাইন বিভাগও ছিল। কিন্তু, অনলাইন বিভাগের আফিস ছিল মূল অফিস থেকে বিচ্ছিন্ন। একটি অভিন্ন কার্যালয় বা বার্তাকক্ষ থেকে পত্রিকাটি তার ছাপা ও অনলাইন সংস্করণের কাজ একসঙ্গে চালানোর কোনো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।

এ ছাড়া সংবাদপত্র নিয়ে অস্বচ্ছ ধারণার কারণে কর্তৃপক্ষ ছাপা সংস্করণ একটি নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করেছে, কিন্তু অনলাইন সংস্করটি গুগল, ইয়াহুর মতো সংবাদ পরিবেশকের কাছে বিতরণ করেছে বিনা পয়সায়। প্রতিষ্ঠানটি তার কর্মীদের প্রযুক্তি ও তথ্য বিশ্লেষণের (ডেটা অ্যানালাইসিস) কাজে দক্ষ করে তুলতে তেমন কোনো অর্থই খরচ করেনি।

নুতন সম্ভাবনা

খ্যাতনামা বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট বলেছিলেন, একটি ভুল বাণিজ্যিক পরিকল্পনার কারণে একটি বাজারচলতি পণ্যও ব্যবসা ধ্বংস করে দিতে পারে।প্রকাশকদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রকাশকেরা ইন্টারনেটে বিনা পয়সায় পত্রিকা বিলায়, অথচ ছাপা সংস্করণ নগদ অর্থে বিক্রি করে। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে পত্রিকার বিক্রি ধাই ধাই করে কমে যাওয়া ছাড়া আর কিছু তো হতে পারে না!

১৯৯৪ সালের দিকে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের চোখ পড়ে ইন্টারনেট ও আগামী দিনগুলোর দিকে। হিসাব কষতে তিনি আগে থেকেই দারুণ পারঙ্গম। তাই, সেবারও হিসাবে ভুল হলো না। তিনি অর্থ ব্যবস্থাপনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সামান্য পুঁজি সম্বল করে এক অনকোরা ব্যবসা শুরু করেন, যার শেষ ফল হলো বিশ্বের দৈত্যাকৃতির প্রতিষ্ঠান আমাজন ডটকম। প্রায় দুই দশক পরে এবং সপ্তাহ দুয়েক আগে বেজোসের দেখা দুই দুনিয়া একসঙ্গে মিলে যায়। গ্রাহাম পরিবারের কাছ থেকে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকিনে নেওয়ার পরিকল্পনাটি এই দুই দুনিয়াকে এক করার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।

এত বড় একটি পত্রিকা বিক্রি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে বড় দুঃসংবাদ। এসব মানুষ সাংবাদিকতার ভবিষ্যত ও পত্রিকা বিক্রি হয়ে যাওয়ার পেছনে লুকোনো রাজনীতিটি নিয়ে উত্কণ্ঠিত। কিন্তু সত্যি হয়ত এতে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আশার বিষয় হলো, বার্তাকক্ষে নতুন বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। কথা না বাড়িয়ে বলা যায়, খবরের দুনিয়ার মানুষের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তবে এ জন্য তাদের হতে হবে সব্যসাচী। অর্থা এক হাতে খবর আরেক হাতে প্রযুক্তি; চালাতে হবে দুটোই।

আমাজনের উত্থানে প্রচলিত গণমাধ্যম ব্যবসা, যেমন বই প্রকাশ ও বিক্রি, সংগীত ও ভিডিও তৈরি ও বিপণন বিরাট হোঁচট খেয়েছে। অনেক বড় বড় বই ব্যবসায়ীর জন্য যুগের হাওয়ার এই দিক পরিবর্তন সুখকর হয়নি।

সংবাদপত্র বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘দ্য ওয়া

অনেকে মনে করছেন, সামনের দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মাইক্রোব্লগিং আবির্ভূত হবে সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে। কিন্তু, একটি যোগ্য সংবাদপত্র দ্রুত সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে সংবাদের মানের দিকে বেশি নজর দেয়। ব্রেকিং নিউজ (তাজা খবর) পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে লাগাতার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও সংবাদ বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। ফলে, সংবাদপত্র তথ্যের যে দৃঢ় স্তম্ভ তৈরি করতে পারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মাইক্রোব্লগিং ওয়েবসাইটগুলো তা পারে না। তাই, মাধ্যমগুলো ভবিষ্যত সংবাদপত্রের মডেল হতে পারে না।

এগুলো খুব বেশি হলে সংবাদপত্রের পরিপূরক হতে পারে, বিকল্প নয়। ওয়াশিংটন পোস্টও আমাজনের পণ্য, যেমন: কিন্ডেল, ই-রিডার একসঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রাহকদের মধ্যে নতুন আবেদন তৈরি করবে। কনটেন্ট প্রোভাইডার, যন্ত্র প্রস্তুতকারক ও পরিবেশকদের মধ্যে সমন্বয় করে সেবা দেওয়া নতুন হলেও বেশ চলতি বিষয়। এ ছাড়া মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে চলেছে। তাইওয়ানের এইচটিসি ফোন কোম্পানি নতুন ধরনের ফোন তৈরির জন্য গণমাধ্যমগুলোর সঙ্গে অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। newspaper বা সংবাদপত্রের এত দিনের পুরনো সাম্রাজ্য হয়ত এত সহজে ফোরানোর নয়।

নতুন কৌশল

যে ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা দেখা যাচ্ছিল, তা এখন লাভজনক বলে প্রতীয়মান হতে চলেছে। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পাদনা পেশায় নিয়োজিত লোকজনের এক-তৃতীয়াংশই চাকরি হারিয়েছিলেন। এখনো অনেক পত্রিকায় এ ধারা জারি আছে। সম্প্রতি ইউএসএ টুডের মালিক গানেট অনেক শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন। গত কয়েক বছরে সম্পাদকদের পাশাপাশি প্রতিবেদকদের সংখ্যাও কমানোর উদ্যোগ দেখা গেছে। কোনো একটি খবর দ্রুত সংগ্রহ ও ছবি সংগ্রহের জন্য যত কম সম্ভব, প্রতিবেদক পাঠিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করেছেন প্রকাশক ও মালিকেরা।

আবার অনেকে ঝুঁকেছেন, সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার দিকে। এটি কার্যত নতুন বোতলে পুরনো মদ। আগে এ পেশার নাম ছিল আনপেইড স্ট্রিংগার। যারা বিনা পয়সায় গণমাধ্যমের জন্য কাজ করতেন, তারাই ছিলেন আনপেইড স্ট্রিংগার। এ ছাড়া দেশের আনাচ-কানাচে ও বিদেশে প্রতিবেদক নিয়োগ করার বিষয়টিও ক্রমে কমিয়ে দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান।

তবেওয়াশিংটন পোস্টপত্রিকার হাতবদল হয়ত ঘুরিয়ে দিতে যাচ্ছে সবকিছু। চলতি অনেক কৌশল যে ভবিষ্যতের সংবাদপত্রের জন্য একেবারেই বেমানান, তা পরিস্কা হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে একটি বিষয় অনুমান করা যায়, সংবাদপত্র একটি ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে দারুণভাবে বিবর্তিত হতে চলেছে। ভবিষ্যত সংবাদপত্র ডিজিটাল ব্যবসায় বেশি মনোযোগ দেবে, নতুন বিপণনব্যবস্থা তৈরি করবে এবং এর বিষয়বস্তুকে (সংবাদ ও অন্যান্য) করে তুলবে আরো নিখুঁত ও অর্থবহ।

বেজোস গত বছর হেনরি ব্লগেডের কাছ থেকে বিজনেস ইনসাইডারকিনে নিয়েছিলেন। সম্প্রতি, হেনরি ব্লগেড এক কলামে লিখেছেন, স্থিতিশীল ডিজিটাল ব্যবসার উপায় মিলেছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করেছেন। পত্রিকাটি এ ধরনের বিজ্ঞাপন থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। ব্লগেড লিখেছেন, পত্রিকাগুলোতে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়ছে এবং ওয়েবসাইটে পত্রিকার গ্রাহকও বাড়ছে।

ওয়ারেন বাফেট তার স্মার্ট মানিবিনিয়োগ নিয়ে বলেছেন, ‘সমাজমুখি, সমন্বিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ এবং ইন্টারনেট-বিষয়ক সঠিক পরিকল্পনার বদৌলতে সংবাদপত্র আর বহুদিন টিকে থাকবে। মনে হয় না, সংবাদ বা ছাপার সংখ্যা কমিয়ে কোনো সাফল্য আসবে।

আগের প্রজন্মের প্রকাশকদের চেয়ে নতুন প্রকাশকদের দৃষ্টিভঙ্গির তফা হলো, নতুন মালিকেরা খবরের মান বাড়ানোর মধ্যে ভবিষ্যত দেখছেন। অর্থা নতুন যুগে পত্রিকাকে টিকে থাকতে হবে খবরের মান উন্নত করে ও প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে।

[দ্য কনভারসেশন, দ্য চায়না পোস্ট, দ্য জাকার্তা পোস্ট ও বিজনেস ইনসাইডারের সহযোগিতায়]

  (নিবন্ধটি বেঙ্গলিটাইমসটোয়েন্টিফোর থেকে সংগৃহীত)

No comments: