Monday, December 30, 2013

যুদ্ধাহতের ভাষ্য-৫ ‘‘কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী আমি’’






সালেক খোকন
যুদ্ধাহতের ভাষ্য-৫ ‘‘কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী আমি’’
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩


দিনটি ছিল ২৩ মার্চ ১৯৭১মধ্যরাতকালসী আহুরা গ্রামে আগুন দেয় বিহারিরাআগুনে পুড়ে ছাই হয় এক মাস্টারের বাড়িশুরু হয় লুটপাটপরের দিনই দুয়ারীপাড়ায় আগুন দেয় তারাপ্রাণভয়ে আমরা চলে যাই তুরাগ নদীর ওপারেআশ্রয় নিই বিরুলিয়া গ্রামে



ঢাকায় আর্মি নামে ২৫ মার্চ রাতেলোকমুখে সে খবর ছড়িয়ে পড়েসবার মধ্যে তখন আতঙ্কঅজানা ভয়আর্মি আসার শঙ্কা নিয়েই কাটতে থাকে আমাদের দিনগুলো



২৩ এপ্রিল সকালঘরে কোনো খাবার নেইবাবা বললেন, ‘চল, লাল ধান কেটে আনিগাঙের পাড়ে ছিল আমাদের জমিবিকেল পর্যন্ত ধান কেটে আমরা তা মাঠেই স্তূপ করে রাখিধান নিতে নৌকা নিয়ে আসবে ছোটভাই আমজাদ মোল্লাআমরা তার অপেক্ষায় থাকিবিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামেতবুও আমজাদের দেখা নেই



পাশেই ছিল আলব্দী গ্রামআমার বাবা ও মায়ের নানাবাড়িগ্রামের প্রায় সকলেই নিকটাত্মীয়আমরা রাতটা ওইগ্রামেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিইউঠি আমার খালু রোস্তম বেপারির বাড়ি



আলব্দী গ্রাম তখন নারী ও শিশুশূন্যবাড়িগুলোর পাহারায় পুরুষরাসময়টা ধান কাটারতাই বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা কৃষাণরাও আশ্রয় নেয় গ্রামে



২৪ এপ্রিল ১৯৭১ভোর তখনও হয়নিআলব্দী গ্রামের পশ্চিমে তুরাগ নদীর পাড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হেলিকপ্টার নামেদূর থেকে আমরা তা স্পষ্ট দেখিনেমেই তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়আগুন ধরিয়ে দেয় বাড়িগুলোতে

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্জ্ব আমির হোসেন মোল্লা নিজে দেখেছেন কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞ


যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্জ্ব আমির হোসেন মোল্লা নিজে দেখেছেন কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞ
গ্রামে ঢোকার একমাত্র পথটি ছিল কাদের মোল্লা ও বিহারি আক্তার গুণ্ডা, নেওয়াজ ও ডোমাদের দখলেতারাও দলবল নিয়ে আলব্দী গ্রামে ঢোকে সশস্ত্র অবস্থায়পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে অংশ নেয় হত্যাযজ্ঞেগ্রামের নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে নির্বিচারেপাশাপাশি চলে বাড়ি বাড়ি লুটতরাজ


খালুকে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলেন বাবাকিন্তু তিনি যেতে রাজি হন নাবাবা তখন আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েনউত্তরদিকে ক্ষেতের পাশে ছিল একটি ছোট্ট খালখালের কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে থেকে আমরা তাদের হত্যাযজ্ঞ দেখি



সকাল তখন আনুমানিক ৯টাকুয়াশা পুরোপুরি কেটে গেছেখালের ৫০ গজ দূরে ধরে আনা হয় ৫০-৬০ জনকেতাদের লাইন ধরে দাঁড় করায় কাদের মোল্লার লোকেরাহঠাৎ গুলির শব্দএকে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লাইনের সবাইপড়েই ছটফট করতে থাকেনমা গো, বাবা গোআর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠে আলব্দী গ্রামের বাতাস



লাশগুলো পরে ফেলে দেওয়া হয় গ্রামেরই তিনটি কূপেকিছু লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় তুরাগেআমার খালুর লাশ পড়েছিল বারান্দাতেবাড়িটি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও কাদের মোল্লার লোকেরাআগুনে ঝলসে গিয়েছিল খালুর শরীরের অর্ধেকটা



কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞ দেখেছি আমিওইদিন তারা হত্যা করে ৩৪৪ জনকে৬৪ জন গ্রামের স্থানীয় লোকবাকিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা কৃষাণস্থানীয়দের মধ্যে ২১ জনই ছিলেন আমার নিকটাত্মীয়তারা হলেনরুস্তম আলী, সলিমউল্লাহ, আ. আউয়াল মোল্লা, সুলেমান মোল্লা, করিম মোল্লা, জয়নাল মোল্লা, কাশেম মোল্লা, বদরুদ্দিন, জোরা মোল্লা, বিশু মোল্লা, অজল হক, ফজল হক, রহমান বেপারী, নবী মোল্লা, আলামত মিয়া, ধনা মৌলভী, ফুলচান, নওয়াব মিয়া, ইয়াছিন বানু, লালু চান ও সুনু মিয়া



কাদের মোল্লাকে কীভাবে চিনলেন?

  
‘‘মুক্তিযুদ্ধের আগেই আক্তার গুণ্ডা, ডোমা, নেওয়াজ ও কাদের মোল্লাকে চিনতামমিরপুরে বিহারি রিফিউজিদের সংখ্যা ছিল বেশিমাত্র পঞ্চাশটির মতো পরিবার ছিল বাঙালিওরা নির্ভরশীল ছিল সরকারি রিলিফের ওপরবাঙালিদের গাছ থেকে ওরা আম-কাঁঠাল চুরি করে নিতএ নিয়ে বহুবার তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব হয়েছেকখনও-কখনও তা রূপ নিয়েছে হাতাহাতিতে



এছাড়া সত্তরের নির্বাচনে আমরা ছিলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষেজামায়াতে ইসলামের দাড়িপাল্লার পক্ষে ছিল ওরামিরপুরে বিহারিদের নেতৃত্ব দিত আক্তার গুণ্ডাতাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ও রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সংগঠক কাদের মোল্লাস্থানীয় মেম্বার লতিফও ছিল তাদের পক্ষে সক্রিয়মিরপুর ১০ নম্বরে তাদের একটি কার্যালয় ছিলওখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, কামরুজ্জামান, মীর আবুল কাশেম, সরদার আবদুস সালাম প্রমুখের’’



১৯৭১ এ কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞের কথা এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আমির হোসেন মোল্লামিরপুরে আলব্দী গ্রামের গণহত্যায় অংশ নেওয়ার অভিযোগে ২০০৮ সালে ২৩ জানুয়ারিতে তিনিই প্রথম জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ দশজনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি পিটিশন দায়ের করেনআদালতের নির্দেশে ওই পিটিশনটি পল্লবী থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয় ২৫ জানুয়ারি তারিখেমামলার নং ৬০


হাঁটুর উপরের ক্ষত দেখাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্রা
মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লার বাড়ি ঢাকা মহানগরের পল্লবী থানার দুয়ারীপাড়ায়বর্তমান বয়স ৬৭ বছরতার বাবার নাম সুরজত আলী মোল্লা ও মা রাহিমা খাতুনচার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়শিক্ষাজীবনের শুরু মিরপুরের সিন্তাত হাই স্কুলে১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীমুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলির আঘাতে তার ডানপায়ের হাঁটুর ওপরে ও ডানহাতে মারাত্মক জখম হয়


আলাপচারিতায় কথা উঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়েমুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘‘ওইদিন আমরা প্রায় তিনশ জন গিয়েছিলাম রেসকোর্স ময়দানেসবার হাতে হাতে ছিল বাঁশের লাঠিমিরপুরে আমাদের নেতৃত্ব দেন মান্নান খান ও আক্কাস মেম্বারবঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিবতবু এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহশুনেই লাঠি উঁচিয়ে আমরা জয় বাংলাশ্লোগান তুললামসেদিন দেশের জন্য অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে ফিরছিলামবুঝেছিলাম সংগ্রাম ছাড়া মুক্তি নেই’’



আপনারা তখন কী করলেন?



উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে সাতদিনের ট্রেনিং দেওয়া হয় আমাদেরমন্টু ভাই ছিলেন ট্রেনারফিরে এসে নিজ উদ্যোগে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতর আমি ২৭ জনকে কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করাই’’



মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে আমির হোসেন বলেন, ‘‘আলব্দী গ্রামের হত্যাযজ্ঞ আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়তখনই সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ারকিন্তু বাবা-মা টের পেয়ে যানআমাকে আটকে রাখতে তারা আমায় বিয়ে করিয়ে দেনকিন্তু সে মায়ার বাঁধনও আমাকে আটকাতে পারেনিবিয়ের সতের দিনের মাথায় আমি গোপনে বাড়ি ছাড়লামমায়ের কোমরের বিছা আর ৫৬ টাকা ছিল সম্বল’’



কোথায় ট্রেনিং করলেন?



‘‘সময়টা মে মাসের মাঝামাঝিমহির উদ্দিন, আবু নাসের, আবদুল হালিম, ফজল হক ও সাত্তারসহ নৌকাযোগে আমরা আমিনবাজার হয়ে আসি কেরানিগঞ্জেসেখানে আওয়ামী লীগ নেতা মান্নান আমাদেরকে একটি চিঠি লিখে দেনকামারের দোকানে রুপার একটা তাবিজ বানিয়ে তার ভেতর রাখি ওই চিঠিতাবিজটি আমার গলায় ছিলসদরঘাট থেকে কুমিল্লা দশআনির মোহরপুর হয়ে আমরা পৌঁছি কুমিল্লা কাইতলায়চিঠি দেখিয়ে ও মাথাপিছু ৬ টাকার বিনিময়ে সেখানে ওদুদ মিয়া নামে এক লোক আমাদের পৌঁছে দেয় ভারতের আগরতলায়



খয়েরপুর দুর্গা চৌধুরীপাড়া ইছামতি বিজনা ক্যাম্পে নাম লেখাই আমরাসেখান থেকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় আসামের কাছাড় জেলার লায়লাপুর ট্রেনিং ক্যাম্পেসেখানে ছিল তিনটি ক্যাম্পএম উইং, এন উইং ও টি উইংএম (মুজিব) উইং-এ আমি ছিলাম ৬ নং স্কোয়াড আলফা কোম্পানিতেআমাদের ট্রেনিং হয় ২৮ দিন২১ দিন অস্ত্র ও ৭ দিন গেরিলা ট্রেনিংআমার এফএফ নাম্বার ছিল ৯১৯৯৭ট্রেনিং শেষে মেলাঘরে আমাদের শপথ করান কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী’’



কোথায় কোথায় যুদ্ধ করলেন?



মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন বলেন, ‘‘আমরা ছিলাম গেরিলাআক্রমণ করেই সরে পড়তাম২১ জনের দলে আমাদের কমান্ডার ছিলেন মো. হানিফসহকারী কমান্ডার মো. রফিকআমি ছিলাম উত-কমান্ডার (অস্ত্র রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার)অস্ত্র জমা রাখা হত আমার কাছে২ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর এ টি এম হায়দারের নির্দেশে আমরা যুদ্ধ করি মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায়সাদুল্লাপুর বাজার, বাটুলিয়া গ্রাম, আরিচা থেকে আমিনবাজার ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা দখল, নতুন বিমানবন্দর এলাকায় ২৮ রাজাকার আটক প্রভৃতি অপারেশনের কথা আজও মনে পড়ে’’



গুলিবিদ্ধ হলেন কোন অপারেশনে?



প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা আবেগাপ্লুত হনঅতঃপর বলতে থাকেন, ‘‘১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১মিরপুর তখনও স্বাধীন হয়নিআমরা ছিলাম বিরুলিয়ার একটি বাড়িতেত্রিশ-বত্রিশজনরাত তখন ২ টাহঠাৎ খবর আসে বিরুলিয়া ঘাটে পাঞ্জাবি আসারআমরা দ্রুত সেখানে পজিশন নিই



ঘন কুয়াশাকিছুই দেখা যাচ্ছিল নাভোর হতেই দেখলাম নদীর দিকে কুয়াশাভাঙা রাস্তাজেলেরাও বলল, ওই পথেই গেছে ৭ জন পাঞ্জাবিনদীর তে-মোড়ায় (ত্রিমোহনা) গিয়ে আমরা তাদের অ্যাটাক করব, এমনটাই ছিল পরিকল্পনাতুরাগ পার হয়ে আমরা চকের মধ্যে চলে আসিআমাদের নেতৃত্বে সহকারী কমান্ডার রফিকতিনটি দলে আমরা তিনদিকে এগোইআমি পূর্বপার্শ্বেসঙ্গে সাত্তার ও মহিউদ্দিনপাঁচজন গেল পশ্চিম পাশ দিয়েরফিক কমান্ডার চারজনকে নিয়ে এগোয় মাঝ বরাবর



আমরা পাঞ্জাবিদের ১৫০ গজের মধ্যে চলে আসিহঠাৎ পূর্বদিকের বোটানিক্যাল গার্ডেনের শেষ অংশে জন্দী রাডার ক্যাম্প থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকেপাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও বিহারিদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল সেটিআমাদের লক্ষ্য করে তারা মর্টার নিক্ষেপ করেআমরাও গুলি ছুঁড়িকিন্তু তোপের মুখে টিকতে পারি না



ঘণ্টাদুয়েক চলে গোলাগুলিহঠাৎ পেছন দিকে মাগোবলে পানিতে ছিটকে পড়ে সাত্তারতাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায় মহিউদ্দিনআমি তখনও কাদার মধ্যে লাইন পজিশনেগুলি ছুঁড়ছিক্রলিং করে মহিউদ্দিন সামনে আসেজানায় সাত্তারের মৃত্যুসংবাদটিমাথায় গুলি লেগেছিল তার



আমি মহিউদ্দিনকে পজিশন নিতে বললামহঠাৎ সে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘তোর হাঁটুতে রক্তকখন যে গুলি লেগেছে টেরই পাইনিগুলিটি আমার ডানপায়ের হাঁটু দিয়ে ঢুকে উরু দিয়ে বের হয়ে ডানহাতের বাহু ভেদ করে রেরিয়ে যায়দেখলাম, রক্তে ভিজে গেছে গোটা পাহাড়ের হলুদ মজ্জাগুলো বেরোচ্ছিল তখনআমি স্থির হয়ে যাইমনে তখন মৃত্যুভয়অবশ হয়ে যাচ্ছিল ডানহাতডানপাও নাড়াতে পারছিলাম নাশরীর শুধুই ঘামছিলধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে চোখদুটো



নৌকায় করে আমাকে নেওয়া হয় বিরুলিয়ায়নবীউল্লাহ নামে এক গ্রাম্য ডাক্তার কাঁথা সেলাইয়ের সুই দিয়ে আমার পা সেলাই করেআমি তখনও অজ্ঞানজ্ঞান যখন ফিরল তখন ঢাকা মেডিকেলেওই অপারেশনে দুজন পাঞ্জাবি নিহত এবং ৫ জন সারেন্ডার করেছিল’’



যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতে পিটিশন
বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমির হোসেন নিজের মতামতটি তুলে ধরেন অকপটেতিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ সারেন্ডার করলে তাকে ক্ষমা করা হয়সে হিসেবে ছোট ছোট অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা করেছিলেনকিন্তু তিনি ক্ষমা করলেও তারা তো বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমা করেননিতাই আমি মনে করি বঙ্গবন্ধু ভুল করেছিলেনএই ভুলের মাসুল তাকে দিতে হয়েছে’’


তিনি আরও বলেন, ‘‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সত্যিকিন্তু স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে রাজাকারদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি কোনোদিনও জাতির কাছে ক্ষমা পাবেন নাতার দলের হাত ধরেই এদেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হয়েছে রাজাকাররাজাতির জন্য ওটা ছিল কলঙ্কজনক অধ্যায়’’



যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা বর্তমানে ঢাকা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘যারা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে তারা নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও অস্ত্র জমা দিয়েছেনস্বাধীনের পরেই ওই তালিকা নিয়েই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা যেতযারা প্রশিক্ষণ নেয়নি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তাদের অবদানও কম ছিল নাতাই তালিকা না বাড়িয়ে তাদের আলাদা তালিকা তৈরি করা যেত’’



তিনি মনে করেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নয়, বরং স্বাধীনতার পরেই রাজাকারদের তালিকা করা উচিত ছিল



এদেশের সন্তানরা যখন সারা পৃথিবীতে সফল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায় তখন আনন্দে মন ভরে যায় এ বীর মুক্তিযোদ্ধারখারাপ লাগার অনুভূতি জানাতে তিনি বলেন, ‘‘ক্ষমতার জন্য যখন রাজনীতিবিদরা হানাহানিতে লিপ্ত হয়, দেশের বিরুদ্ধে যখন তারা কথা বলে, তাতে দেশেরই ক্ষতি করেতখন খুব খারাপ লাগে’’



কথা ওঠে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা নিয়েমুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘‘কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধ হয়েছেএ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে এমনটাই আশা সবারকিন্তু বিচারের রায় যখন অন্যদিকে যাচ্ছিল তখনই জেগে ওঠে তরুণরাযুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তারা গড়ে তুলে গণজাগরণ মঞ্চবিচার না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চয়ই এ তরুণরা সজাগ থাকবে’’



মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে আশা নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘‘তোমরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত কর নান্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিপক্ষে থেকতোমরা দেশের প্রতি থেক আস্থাশীলদেশ হল মামায়ের মতোই তাকে ভালোবেস’’



সংক্ষিপ্ত তথ্য



নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আমির হোসেন মোল্লা
ট্রেনিং নেন: আসামের কাছাড় জেলার লায়লাপুর ট্রেনিং ক্যাম্পেএম (মুজিব) উইং-এ তিনি ছিলেন ৬নং স্কোয়াড আলফা কোম্পানিতে
 
এফএফ নং : ৯১৯৯৭


যুদ্ধ করেছেন: ২ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেন মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায়

যুদ্ধাহত: ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১সকালেবোটানিক্যাল গার্ডেনের শেষ অংশে জন্দী রাডার ক্যাম্প থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি তার ডানপায়ের হাঁটু দিয়ে ঢুকে উরু দিয়ে বের হয়ে ডানহাতের বাহু ভেদ করে রেরিয়ে যায়

ছবি: সালেক খোকন
সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক


This entry was posted on সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩ at ৩:২৭ অপরাহ্ণ and is filed under মুক্তিযুদ্ধ.  
You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0 feed.

WARNING: Any unauthorised use or reproduction of bdnews24.com content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

No comments: