বাঙালি মানে হিন্দু?
বাঙালি
মানে হিন্দু, এটা কখনো জানা ছিল না। আমরা জানি আমাদের জাতিসত্তা
হলো- বাঙালি। এর মধ্যে আবার কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু, কেউ-বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান। আদিবাসীদের বাদ দিয়েই
বলছি। তবে আদিবাসীদের মধ্যেও বৌদ্ধ ছাড়াও হিন্দু ও খ্রিস্টান আছেন।
যাক, আমি যেখানে ভাড়া থাকি, সেই বাসার মালিকের
দুই আত্মীয় কোলকাতা থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন দিন কয়েক হলো। যেদিন তারা আসলেন, আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাড়িওয়ালি (ল্যান্ডলেডি)।
তাদের
একজন কোলকাতার একটি বিমান সংস্থায় কাজ করেন। আরেকজনের পার্ক সার্কাসে নিজেদের দোকান। সেই দোকানেই বসেন।
আমি যখনই
রুমে থাকি, তখনই শুনি সবাই মিলে হিন্দিতে কথা বলছেন। মনে প্রশ্ন জাগলো, ওরাও তো বাঙালি। আবার যাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন, তারাও বাঙালি। তবে কেন হিন্দিতে কথা বলা!!
তবে বলে
রাখি, আমাদের ল্যান্ডলেডি ও তার হাজবেন্ড পূর্বপুরুষ সূত্রে ভারতীয়। যখনই তাদের নিজেদের
মধ্যে কথা বলতে শুনেছি, তখনই তারা হিন্দিতে কথা বলছেন। এমনকী নিজেদের মধ্যে
কাউকে ফোন দিলে বা আসলে হিন্দিতেই কথা বলেন। শুনতে খারাপও লাগে না। বরং মিষ্টিই লাগে। কৌতূহল জাগে, আমিও যদি হিন্দি ভাষাটা রপ্ত করতে পারতাম,তাহলে আরো একটা ভাষায় দখলদারিত্ব থাকতো! কিন্তু, হিন্দির আমি কিছুই জানি না, বুঝিও না। যদিও আমাদের দেশের
শিশু-কিশোর-কিশোরীরা হিন্দি সিরিয়ালের বদৌলতে অনর্গল হিন্দি বলতেও পারে আবার তা ভালো
বোঝেও। তাদের দুটো ভাষায় ভালো দখল- একটা হচ্ছে ইংরেজি অন্যটি হিন্দি
(আমি ঢাকার শিশু-কিশোরদের কথা বলছি)।
শনিবার
দিনশেষের রাত সাড়ে ১২টা হবে।
তখন কোলকাতা থেকে আসা বাড়িওয়ালির আত্মীয় দুজন
খাবার টেবিলে হিন্দিতে কথা বলছেন। বাড়িওয়ালি,
তার হাজবেন্ডসহ ডিনার করছেন আর গল্প করছেন হিন্দিতেই।
আমার
কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আমি জানতে চাইলাম, আচ্ছা, আপনারা সবাই তো বাঙালি, তাহলে হিন্দিতে কথা
বলছেন কেন? আমাদের বাড়িওয়ালি বললেন, ও তো বাংলা ভালো জানে
না। আমি বললাম,
কেন? উনার বাড়ি কোলকাতার পার্ক সার্কাসে
না? উত্তরে বাড়িওয়ালি বললেন- হ্যাঁ। আমি আবার বললাম, কোলকাতায় উনার বাড়ি না? বাড়িওয়ালি আবারও বললেন, হ্যাঁ। তাহলে উনি কি বাঙালি না? এবার উত্তর দিলেন কোলকাতা
থেকে আসা রশিদ রহমান। তিনি যা বললেন, তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম!
তিনি বললেন, 'আমি তো বাঙালি না। আমি তো মুসলমান!'
আমার
মাথায় হাত। বলে কী!! আমি বাড়িওয়ালি ও তার হাজবেন্ডের দিকে আঙুল তুলে বললাম, তারা তো বাঙালি। তারা যেমন মুসলমান, তেমনি বাঙালিও।
উত্তর
দিলেন, বাড়িওয়ালি। তিনি বললেন,
'ওরা বাঙালি বলতে হিন্দুদের বোঝে।' রশিদ রহমানও মাথা দোলালেন। আমি থ মেরে গেলাম। কারণ, আমার সামনে যারা, তারা আমাদের বাড়িওয়ালা ও বাড়িওয়ালি। তারা যেমন মুসলমান, তেমনি জাতিসত্তায় বাঙালিও।
কিন্তু
এই রশিদ রহমান আমাকে বলতে পারলেন না যে, আসলে তাদের জাতিসত্তা
কী! তারা কোলকাতার আদি বাসিন্দা। কিন্তু, এদের তো জাতিসত্তা
আছে। অথচ রশিদ রহমান জানেন না। শুধু জানেন, তারা মুসলমান।
আর বাঙালি মানে হিন্দু। অর্থাৎ যারা বাঙালি, তারাই হিন্দু। অথবা যারা হিন্দু, তারাই বাঙালি। এটা নাকি কোলকাতার
সবাই জানে। কিন্তু আমরা যারা জাতিসত্তায় বাঙালি আর নাগরিকত্বের দিক দিয়ে
বাংলাদেশি, তাদের
এই কোলকাতার বাসিন্দার কথা শুনলে তো মাথায় হাত পড়বেই!! কিন্তু রশিদ রহমান কোন জাতিসত্তা
বহন করছেন, তা তারা জানেন না। ধর্মের পরিচয়ে নিজের জাতিসত্তার পরিচয় হারিয়ে ফেলেছেন রশিদ রহমানরা। কিন্তু এরা কি কখনো
জানতে পারবেন, তাদের জাতিসত্তা কী। ধর্ম যাই হোক না কেন! যদি তা না জানতে পারেন, তাহলে এর জন্য দায়ী কে? রাষ্ট্র না সমাজ নাকি
ধর্ম?
No comments:
Post a Comment