আমার চোখ
উত্তম-সুচিত্রার যদি বিয়ে হত
মাধবী মুখোপাধ্যায়
আজ আমার প্রথম ব্লগ নিয়ে
কথা বলা! সবটাই স্মৃতি হাতড়ে ফিরে দেখা।
তাই সময় ধরে নয়, আজ আমার শুরুর দিকের টলিপাড়ার না-দেখা সুচিত্রা সেন আর সহকর্মী
উত্তম কুমারের স্মৃতির ইশারা আমার চোখ ভরিয়ে দিচ্ছে।
সুচিত্রা সেনকে আমি
কোনওদিন দেখিনি। আর দেখার ইচ্ছেও আমার কোনওদিন হয়নি। যে মানুষ নিজে থেকেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি
থেকে সরে গেলেন,
থেমে গেলেন তাঁকে যেচে দেখতে চাইব কেন?
সুচিত্রা সেন-এর মেক আপ
আর্টিস্ট শৈলেন গঙ্গোপাধ্যায় আর পরিচালক অসিত চৌধুরির কাছ থেকেই আমার সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানা। শৈলেন
গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি মেক-আপ রুমে কাউকে ঢুকতে
দিতেন না সুচিত্রা সেন। রোদ বা বৃষ্টিতে
স্টুডিও পাড়ায় উনিই তখনকার দিনের একমাত্র নায়িকা,যাঁর
মাথায় ছাতা ধরার লোকও আলাদা ছিল। আমি
মনে করি তাঁর ডমিনেট করার জোর তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা
থেকেই এসেছিল। নিশ্চই তাঁর জীবনে কোনও যন্ত্রণা ছিল। এবং সেই যন্ত্রণা থেকেই উনি ওই ঐশ্বরিক ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। ওঁর
সমতুল্য কোনও মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে উনি
মেশেননি। ওঁর এই ধারাকে আমি আমার জীবনে
নিতে চেষ্টা করেছি।আমারও মনে হয়, আমার থেকে উঁচু স্তরের মানুষের সঙ্গে না মিশলে তো আমার চরিত্রের কোনও উত্তরণ হবে না। আর
আমিও কিছু সেখান থেকে আরোহণ করার উৎসাহ পাব না।
আজকের দিনে আরও একটা কথা
খুব মনে হয়,
সুচিত্রা সেন কোনওদিন স্তাবকতা পছন্দ করতেন না। আমি নায়িকা, আমার চারিদিক দর্শকের মুগ্ধতায় মুখরিত হবে এ তিনি ঘুণাক্ষরেও চাননি। আমিও এই
ধারাকে অনুসরণ করি। আমারও কোনও স্তাবক নেই।
এই লোক দেখানো গ্ল্যামারের
আলো থেকে বেরিয়ে আসার প্রসঙ্গে আরও একটা কথা আজ মনে পড়ছে। অসিত চৌধুরি তখনকার অভিনয় জগতের নাম করা
একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই, বিশেষ করে সব নায়িকারাই তখন চাইত উনি যাতে সুচিত্রা সেন-এর কাছে না যান। সকলেই চাইত অসিত চৌধুরি ‘আমার কাছে, আমার হয়ে থাকুন’। কিন্তু আমি ওঁকে বলতাম, আপনি
যান সুচিত্রা সেন-এর কাছে। ওঁর সঙ্গে গল্প করুন। আমার মনে আছে উনি যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোম-এ, আমি ওঁকে, মানে অসিত চৌধুরিকে দেখতে গেছি। তখন আমাকে
দেখেই প্রথমে উনি বললেন, ‘এসেছিল! মাথায় জপ করে দিয়ে গেছে’। মানে উনি বলতে চাইলেন সুচিত্রা সেন এসে
মাথায় জপ করে দিয়ে গেছেন। অদ্ভুত একটা
কঠিনে কোমলে গড়া ছিল সুচিত্রার মন।
শৈলেন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ
থেকে আমার শোনা,
পরিচালক নীরেন লাহিড়ি সুচিত্রা সেন-এর অভিনয় জীবনের প্রথম দিকে সুচিত্রা সেনকে
প্রপোজ করেছিলেন। সুচিত্রা সেন সেটা অ্যাক্সেপ্ট তো করেননি, উল্টে সেখান থেকে চলে আসেন। আর ফিরে যাননি। তখন নীরেন গাঙ্গুলি সুচিত্রা সেনকে
বলেছিলেন,
‘তুমি যদি কোনওদিন নায়িকা হও তাহলে আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে’। এই
ঘটনার অনেকদিন পার হয়ে গেছে। তখন সিঁথির
মোড়ের ন্যাশনাল সাউন্ড স্টুডিওতে নীরেন লাহিড়ি টেনিস খেলছেন, আর সুচিত্রা সেন তখন স্টার! সুচিত্রা
সেন ওঁকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কই
আপনার হাত দেখি,
দেখিই না’! নীরেনবাবু
তো চমকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কেন? কেন রমা?’ সুচিত্রা সেন-এর সাফ জবাব 'আমি তো নায়িকা হয়ে গেছি! আপনার
তো হাতে চুল গজায়নি'! বলে এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে উনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। উনি ঠিক কথাটা মজা করে বলে দিতে পারতেন। কিন্তু
সবটাই কি
মজা? লোকে
বলে সেটা মজা ছিল। মুনমুন-ও খুব মায়ের মতো মজা করতে পারে। এই হিউমারটা আমার মনে হয় ওর সুচিত্রা সেন-এর থেকে পাওয়া। তবে
মিসেস সেন-এর মজাটা আমরা দেখতে পাইনি মিস করেছি।
শৈলেনদার কাছেই শোনা
সুচিত্রা সেন একবার শিম্পাঞ্জি পুষলেন। কিছুদিন পোষার পরে উনি সেটা শৈলেনবাবুকে দিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই
শিম্পাঞ্জি সিগারেট, চা
সব খেত।ভাবুন! আমরা পুষলে কি পুষব? পাখি, কুকুর, বেড়াল। উনি পুষলেন শিম্পাঞ্জি! সবটাই ওঁর অন্যরকম।
উত্তমবাবুর কাছে শুনেছি, ওঁদের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। দুজনে অসম্ভব বন্ধু ছিলেন। আর এই
বন্ধুতার মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল। প্রেম ছিল না কিন্তু! ওঁরা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন না। অধিকাংশ
মানুষের ধারণা ওঁদের অভিনয়টাই আসলে প্রেম ছিল। তা
কিন্তু নয়,
তাহলে তো যে মার্ডারারের চরিত্র করে তাকেও তো মার্ডার করতে হবে। কিন্তু উত্তম
সুচিত্রার বাংলা ছবিতে কোনও বিছানার দৃশ্য, গভীর চুম্বনের দৃশ্য, কিছু
কি ছিল?
ছিল না! এসবের তো দরকারও পড়েনি কখনও। অথচ আজ এবং আজীবন বাঙালির সেরা
রোম্যান্সের জুটি বললে উত্তম-সুচিত্রার ছবিই ভেসে ওঠে। সুচিত্রা
সেন-এর একটা স্টাইল ছিল। যে চরিত্রই করুন না কেন সবসময় মনে আসে
আমাদের উনি সুচিত্রা সেন, চরিত্রটার কথা কিন্তু মনে আসে না। এটাই ম্যাজিক। এমনও হয়েছে
উত্তমবাবুর মুখে শুনেছি, সুচিত্রা সেন উত্তমকুমারকে বলছেন 'আমি কিন্তু এত টাকা চাইব আর তুইও বাড়িয়ে এত টাকা বলবি'– কখনও তুমি, কখনও তুই করে বলতেন, এতটাই
বন্ধুতা ছিল। আর দর্শক হিসেবে আমরা সক্কলে ভাবতাম উত্তম
সুচিত্রার যদি বিয়ে হত! লোকে অবশ্য এটাও বলে যে
ওঁদের বিয়ে হলে বিয়েটা টিঁকত না!
কারণ দুজনেই খুব ডমিনেটিং ছিলেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়। উত্তমকুমার
কোনওদিনই ডমিনেটিং ছিলেন না। আসলে অহঙ্কার তো ভয় থেকে আসে। সেটা
উত্তমকুমারের থাকতে যাবেই বা কেন? ওঁর অহং বোধ ছিল। সেটা তো থাকবেই, রবীন্দ্রনাথের কথায় আছে 'অহংবোধ না
থাকলে মানুষ শ্যাওলার সমান হয়'। কিন্তু
সুচিত্রা সেন-এর ক্ষমতা এতটাই ছিল যে, মস্কোয় ‘সাত পাকে বাঁধা’-র
জন্যে বেস্ট অ্যাক্ট্রেস অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পরে পার্টিতে,কলকাতায় সুচিত্রা সেন সকলের সামনে
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিয়েছিলেন। সেটাও
কি কেবল মজাই ছিল?
আপনারা এবার ভাবুন... আমি বলব না...
শুনলেন : স্রবন্তী
বন্দ্যোপাধ্যায়
Source: